ইতিহাসে কোথায় তাঁদের অবস্থান?

Ela
Ela
8 Min Read

রমা চৌধুরীকে নিয়ে দু’লাইন লিখতে বসেছি। যখন রমা চৌধুরীকে নিয়ে চিন্তা শুরু করি তখন তা রমা চৌধুরীর মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে লাখ লাখ রমা চৌধুরীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। কে এই রমা চৌধুরী? যারা তাঁকে চেনেন তারা একবাক্যে বলবেন তিনি একজন ‘বীরাঙ্গনা’। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রায় চার লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হন। কেউ নির্যাতনের পর স্রেফ লাশে পরিণত হন, কেউ নির্যাতন সহ্য করেছেন দিনের পর দিন। এই নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দেয়া হয় ১৯৭২ সালে। এই বীরাঙ্গনাদেরই একজন আমাদের রমা চৌধুরী। রমা চৌধুরী তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের স্নাতকোত্তরদের মধ্যে প্রথম নারী ছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১ বছর। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি তিন সন্তান ও বৃদ্ধ মা’সহ তার পৈত্রিক ভিটায় বসবাস করছিলেন, স্বামী ভারতে ছিলেন। ১৩ মে ভোরে তার বাড়িতে পাকিস্তানি আর্মি হামলা চালায়। তাকে ধরে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে, সোজাভাবে আপনারা যাকে বলেন ‘ধর্ষণ’। তিনি আত্মরক্ষার তাগিদে দৌড়ে পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। পরে পাকিস্তানি আর্মি গানপাউডার ছিটিয়ে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বেঁচে গিয়েছিলেন রমা চৌধুরী। সত্যি কি তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন? সেইদিনের পর শুরু হয় তার নতুন জীবন, যে জীবনে প্রতি পদে পদে ছিলো তথাকথিত সতীত্ব হারাবার লাঞ্ছনা, গঞ্জনা; সন্তান হারাবার কষ্ট। ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাঁকে তিন শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। সেই সময়েই তাকে অসতীর তকমা দেয়া হয়। এসব ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় তার লেখা ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে। তার ভাষায় উঠে এসেছে সেই দিনগুলোর কথা— “আমাদেরকে দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই আসছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করছে অশ্রাব্য ভাষায়। দু’তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজোকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে তারা কানে আঙুল দিতে বাধ্য হয়। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না।”

ঘরবাড়িহীন, শীতবস্ত্রহীন আটটি মাস কাটাতে কাটাতে তার দুই সন্তান সাগর আর টগর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর তার বড় সন্তান সাগর অসুখে ভুগে মারা যায়। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একই অসুখে মারা যায় দ্বিতীয় সন্তান টগর। সন্তানদের হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যান রমা চৌধুরী। প্রথম সংসারের সমাপ্তি ঘটলে দ্বিতীয়বারের মত সংসার শুরু করেন। কিন্তু সেখানে প্রতারণার শিকার হন। ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাঁর আরেক সন্তান টুনু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। হিন্দুধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করতেন না রমা চৌধুরী। তাই তার তিন সন্তানকেই মাটিচাপা দেয়া হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি তিনি। এরপর নিকটজনের পীড়াপীড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পরা শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর থেকে গত ১৯ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী। যে মাটিতে শুয়ে আছে তার সন্তান এবং লাখ লাখ শহীদ সেই মাটিতে জুতো পরবেন না বলে শপথ করেছিলেন এই নারী। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন রমা চৌধুরী। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানির বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তাঁর জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। সেই পেশা এখনো বর্তমান। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

শেষ খবর শুনেছিলাম- রমা চৌধুরী অসুস্থ হয়ে খুলশী ডায়াবেটিস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপেও ভুগছিলেন। তার বইয়ের প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকনের কাছ থেকে জানা যায় অসুস্থতার জন্য তিনি দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখি করতে পারছেন না, এদিকে ডাক্তাররাও তার সুস্থতার কোনো আশ্বাস দিতে পারছেন না।

রমা চৌধুরী জনমানুষের সামনে কবে আসলেন? তাকে নিয়ে দীর্ঘ চারবছর লেখালেখি হলে ২০১৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসেন, স্বাধীনতার ৪১ বছর পর! আমরাও তাঁকে চিনতে শুরু করি। এই ৪১টি বছর তিনি নিজের আত্মশক্তিকে পুঁজি করে টিকে ছিলেন। শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই নারীকে প্রধানমন্ত্রী সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোনো সাহায্য নেননি। বরং প্রধানমন্ত্রীর হাতে সেদিন তুলে দিয়েছিলেন তাঁর লিখা তিনটি বই। তার কাছের মানুষেরা জানেন- রমা চৌধুরী কারো কাছ থেকে সাহায্য নেননি কখনো। বই বিক্রির টাকা দিয়ে দিনাতিপাত করতেন। কোনদিন বই বিক্রি না হলে উপোস থাকার নজিরও ছিলো। পথে পথে খালি পায়ে ঘুরে নিজের লেখা বই ফেরি করতেন তিনি। এই রমা চৌধুরী এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের আটটি মাস যে দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন স্বাধীনতা পরবর্তী স্বাধীন বাংলা কি তার কষ্ট লাঘব করতে পেরেছিলো? নাকি স্বাধীন বাংলায় শুরু হয়েছিলো তার নতুন জীবনসংগ্রাম?

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ধর্ষিত/নির্যাতিত/লাঞ্ছিত নারীদের যেভাবে ‘আত্মত্যাগে মহান বীরাঙ্গনা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় সেই মহান নারীদের জীবন কেমন কেটেছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলায়? যেকোনো যুদ্ধে গণহত্যা আর ধর্ষণ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তথাকথিত সতীত্বকে নারীর একমাত্র অবলম্বন হিসেবে তৈরি করবার যে পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব সেই মনোভাব থেকেই মনে করা হয়- নারীর তথাকথিত সতীত্বকে আঘাত করবার মধ্য দিয়ে সেই জাতিকে আঘাত করা যায়, নাজুক দুর্বল করে দেয়া যায়। স্বাধীন বাংলায় মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত এই নারীরা বীরাঙ্গনা খেতাব পাওয়া ছাড়া ইতিহাসের পাতায় কোথায় অবস্থান করছেন?

এই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, এ জাতীয়তাবাদ স্রফে পুরুষের ইতিহাস, পুরুষালী জাতীয়তাবাদ যেখানে রমা চৌধুরীদের স্থান নেই। রমা চৌধুরীরা পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন (কিংবা আসেনও না) স্বাধীনতার ৪১ বছর পর। কেননা আমরা মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে সম্মানিত হতে যতটা গর্ববোধ করি, বীরাঙ্গনাকে নিয়ে আমরা সম্মানিত বোধ করি না, বরং লজ্জা পাই। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত ৭১ জন নারীর নামও কি আমরা জানি? জানিনা। কেননা বীরাঙ্গনার ইতিহাস সম্ভ্রমহানির ইতিহাস, এ লজ্জার ইতিহাস, এ সতীত্বনাশের ইতিহাস। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্তরের সম্মানে ভূষিত করা হয়, কিন্তু একজন বীরাঙ্গনা শুধুই বীরাঙ্গনা। সেখানে বীরত্বের চেয়ে আছে লজ্জা, কষ্ট। রমা চৌধুরী হাসপাতালের বেডে শুয়ে দিন গুনছেন। বইয়ের ফেরিওয়ালা একাত্তরের জননী স্বাধীন বাংলায় কি কোনো স্বপ্ন দেখেছিলেন? তিনি যখন নির্যাতন লাঞ্ছনার স্মৃতি মনে করবার চেষ্টা করেন তখন কি শুধু ’৭১ এর সেই ১৩ মে দিনটিই তার মনে পড়ে? নাকি স্বাধীন বাংলায় গালভরা ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবধারী প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত-বঞ্চিত একজন রমা চৌধুরীকে তার মনে পড়ে? রমা চৌধুরীরা কি এমন স্বাধীন বাংলা চেয়েছিলেন যেখানে তারা পরিচিতি পান স্বাধীনতার ৪১ বছর পর? রমা চৌধুরীরা কি এমন স্বাধীন বাংলা চেয়েছিলেন যে বাংলা নারীর সতীত্ব হারাবার লজ্জায় ‘নির্যাতিতা’ ‘ধর্ষিতা’ নারীর নাম, তালিকা, দলিলপত্র পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছিলো? মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ড. ডেভিসের ভাষায় ফুটে উঠে হতাশা- ‘না, তখন কেউই এটা নিয়ে কথা বলতে চায়নি। পুরুষেরা এ নিয়ে একদম কথা বলতে রাজি নয়। তাদের চোখে এসব নারী নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো তাদের মরে যাওয়াই ভালো ছিল এবং পুরুষেরা সত্যিই তাদের মেরেও ফেলেছিল।’ (সাক্ষাৎকার, বিনা ডি কস্টা, ২০০২) রমা চৌধুরীরা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছেন। মনে রাখা উচিত, শুধু ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে নেই, চার লাখ নারীর নির্যাতন লাঞ্ছনার উপরও আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যে নারীরা স্রফে চাপা পড়ে গেছেন ইতিহাসের পুরুষালী গৌরবের নিচে। অথচ রমা চৌধুরীদের বেঁচে থাকবার কথা ছিলো ইতিহাসের চূড়ায় উজ্জ্বল মুকুটের বেশে, মাথা উঁচু করে! যেখানে প্রতিটি ভোরে সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠবার কথা ছিলো রমা চৌধুরীদের।

প্রকাশঃ দৈনিক একতা, ২০১৭

লিংকঃ https://weeklyekota.net/?page=details&serial=5092

Share This Article
Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *